আরাফার দিবস
· তারিখঃ জিলহজের ৯ তারিখ আরাফার দিন
· এটিও বলা হয়ঃ তওবা ও দোয়া কবুলের দিন। সবচেয়ে উত্তম দোয়া হ’ল আরাফাহ দিবসের দোয়া।
· পালনঃ নামাজ, রোজা, তওবা, দোয়া
· স্থানঃ আরাফাত পর্বত হল মক্কা থেকে প্রায় ২০ কিমি (১২ মাইল) দক্ষিণ-পূর্বে আরাফাতের ময়দানে অবস্থিত একটি পাহাড়। এটি "রহমতের পর্বত" (জাবাল আর-রহমাহ) নামে পরিচিত। এই পাহাড়টি সেই স্থান যেখানে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) দাঁড়িয়ে তাঁর জীবনের শেষ দিকে হজ্জের জন্য তাঁর সাথে আসা মুসলমানদের বিদায়ী খুতবা দিয়েছিলেন।
তাৎপর্যঃ আরাফাতের দিন বা আরাফার দিন ইসলামের একটি পবিত্র দিন যেটি এই ধর্মের পরিপূর্ণতা লাভের দিবস হিসেবে পরিচিত যা ইসলামিক চন্দ্র পঞ্জিকা অনুসারে জিলহজ মাসের ৯ তারিখে সংগঠিত হয়। এই দিনের ভোরে, মুসলিম হজ্জ্ব যাত্রীরা মিনা থেকে যাত্রা করে নিকটবর্তী পাহাড়ের সন্নিকটবর্তী-সমভূমি আরাফাতের ময়দানে এসে উপস্থিত হন। এই দিনটিতেই হযরত মুহাম্মদ (স.) তার জীবনের শেষ বছর এই স্থান থেকেই তাঁর শেষ খুতবা/বিদায় ভাষন দিয়েছিলেন। কিছু মুসলিম মনে করেন যে ইসলাম ধর্ম পরিপূর্ণ হয়ে গেছে বলে ঘোষণা করে কুরআনের আয়াতের অংশটি এই দিনেই নাজিল হয়েছিল।
আরাফাহ দিবসের ফযীলতঃ আরাফাহ দিবসের বিভিন্ন ফযীলত রয়েছে। যেমন-
১. আরাফাহ দিবসের রোজা দু’বছরের গোনাহের কাফফারাঃ
অ-হাজীদের জন্য আরাফার দিনে রোজা রাখা অত্যন্ত সুন্নত, যার ফলে মহান সওয়াব লাভ করা যায়; আল্লাহ দুই বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দেন। আবু কাতাদাহ থেকে বর্ণিত যে, মুহাম্মদকে আরাফার দিনে রোজা রাখার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল এবং তিনি উত্তর দিয়েছিলেনঃ
এটি অতীত এবং আগামী বছরের জন্য প্রায়শ্চিত্ত করে।
এই দিনগুলিতে হজযাত্রীদের রোজা রাখতে নিষেধ। অন্যদিকে, যারা হজ পালন করছেন না তারা পবিত্র দিনের ফজিলত অর্জনের জন্য রোজা করবেন। এই কথা বলা হয়ে থাকে যে, একজন বিশ্বাসী যদি এই দিন রোজা রাখে তবে তার পূর্বের বছরের এবং পরবর্তী বছরের পাপ হতে মুক্তি পায়।
২. আরাফার দিন গুনাহ মাফ ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের দিন :
সহীহ মুসলিমে আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেনঃ
“‘আরাফার দিন আল্লাহ রাববুল আলামীন তাঁর বান্দাদের এত অধিক সংখ্যক জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন, যা অন্য দিনে দেন না। তিনি এ দিনে বান্দাদের নিকটবর্তী হন ও তাদের নিয়ে ফেরেশতাদের কাছে গর্ব করে বলেন, তোমরা কি বলতে পার আমার এ বান্দারা আমার কাছে কি চায়?’’
ইবনে আব্দুল বার্র (রহঃ) বলেন, এ দিনে মুমিন বান্দারা ক্ষমাপ্রাপ্ত হন। কেননা আল্লাহ রাববুল আলামীন গুনাহগারদের নিয়ে ফেরেশতাদের কাছে গর্ব করেন না। তবে তওবা করার মাধ্যমে ক্ষমা-প্রাপ্তির পরই তা সম্ভব।
৩. অধিক পরিমাণে যিকর ও দোয়া করার উপযুক্ত সময়ঃ
বছরের শ্রেষ্ঠ দিন আরাফার দিন। আরাফার দিনের দোয়া হলো সারা বছরের মধ্যে যে কোন দিনের চেয়ে শ্রেষ্ঠ দোয়া। নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, সবচেয়ে উত্তম দোয়া হ’ল আরাফাহ দিবসের দোয়া। আর সর্বশ্রেষ্ঠ কথা যা আমি বলি ও আমার পূর্ববর্তী নবীগণ বলেছেন তা হ’লঃ
আরাফার দিনের শ্রেষ্ঠ দোয়াঃ
লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহু, লাহুল মুলক ওয়া লাহুল হামদু, ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শায়ইন কাদির। আল্লাহ ব্যতীত সত্যিকার কোন মা‘বূদ নেই, রাজত্ব তাঁরই, সকল প্রশংসা তাঁরই প্রাপ্য এবং তিনি সকল বিষয়ে সর্বশক্তিমান।
ইমাম খাত্ত্বাবী (রহঃ) বলেন, এ হাদীছ দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, দো‘আ করার সাথে সাথে আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা ও তাঁর মহত্বের ঘোষণা করা উচিত।
আরাফা দিবসের মূল আমল ‘দোয়া’।
আরাফা দিবসের মূল আমল দোয়া। দোয়ার কিছু আদব ও কায়দা-কানুন আছে যেগুলোর অনুসরণ দোয়া কবুলে সহায়ক হতে পারে। নীচে দোয়ার কিছু আদব উল্লেখ করা হল।
· শুদ্ধ নিয়তঃ অর্থাৎ দোয়া আরম্ভের সময় মনে মনে নিয়ত করবেন যে আপনি একটি মহৎ ইবাদত বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছেন। কেননা ‘দোয়াই ইবাদত’ বলে হাদিসে এসেছে।[1] মনে মনে এ ধরনের ভাবও উদ্রেক করবেন যে একমাত্র আল্লাহই সমস্ত হাজত পুরা করতে পারেন। হাজত-প্রয়োজন পুরা করা অন্য কারো পক্ষে সম্ভব নয়।
· ওজু অবস্থায় দোয়া করাঃ কেননা ওজু ব্যতীত দোয়া করা জায়েয হলেও যেহেতু দোয়া একটি ইবাদত তাই ওজু অবস্থায় করাই উত্তম।
· হাতের তালু চেহারার দিকে ফিরিয়ে দোয়া করাঃ হাদিসে এসেছে, ‘আল্লাহর কাছে তোমরা যখন সওয়াল করবে, হাতের তালু দিয়ে সওয়াল করবে। হাতের পিঠ দিয়ে নয়।[2] রাসূলুল্লাহ (ﷺ)দোয়া করার সময় হাতের তালু চেহারার দিকে রাখতেন।[3] প্রয়োজন ও হাজত প্রকাশের এটাই হল সর্বোত্তম ধরন, যাতে একজন অভাবী ব্যক্তি পাবার আশায় দাতার দিকে বিনয়াবনত হয়ে হাত বাড়িয়ে রাখে।
· হাত এতটুকু উঁচুতে ওঠাবেন যাতে বগলের নীচ দেখা যায়। হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি তার হাত এতটুকু উঠায় যে, তার বগলের নীচ দৃশ্যমান হয়ে উঠে এবং আল্লাহর কাছে আর্জি পেশ করে, আল্লাহ তার আর্জি পূরণ করেন।[4]
· আল্লাহর প্রশংসা ও গুণ বর্ণনার মাধ্যমে দোয়া শুরু করা। রাসূলুল্লাহ (স) অধিকাংশ সময় এভাবেই দোয়া করতেন। এমনকী কেয়ামতের ময়দানে আরশের কাছে সিজদায়রত হয়ে তিনি দীর্ঘক্ষণ আল্লাহর প্রশংসা ও গুণ বয়ান করবেন, এরপর আল্লাহ তাঁকে সওয়াল করার অনুমতি দেবেন, ও বলবেন, হে মুহাম্মদ! মাথা উঠাও, বল, তোমার কথা শোনা হবে। সওয়াল কর দেয়া হবে। শাফায়াত করো, তোমার শাফায়াত মঞ্জুর করা হবে। [5]
· নবী (স) এর প্রতি দরুদ পাঠ করা। কেননা দরুদ ব্যতীত দোয়া ঝুলন্ত অবস্থায় থাকে। হাদিসে এসেছে, ‘প্রত্যেক দোয়া নবী (স) প্রতি দরুদ না পড়া পর্যন্ত বাধাপ্রাপ্ত অবস্থায় থাকে।[6]
· প্রথমে নিজেকে দিয়ে শুরু করা। পবিত্র কুরআনে এর কিছু উদাহরণ এসেছে, যেমন; - হে আমার প্রতিপালক! আমাকে ক্ষমা করুন ও আমার মাতাপিতাকে।[7] - সে বলল, হে আমার প্রতিপালক আমাকে ক্ষমা করুন ও আমার ভাইকে।[8] - হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে ক্ষমা করুন ও আমাদের ভাইদেরকে যারা আমাদের পূর্বে ঈমান অবস্থায় অতিবাহিত হয়েছেন।[9] রাসূলুল্লাহ (ﷺ)ও কারো জন্য দোয়া করলে প্রথমে নিজেকে দিয়ে শুরু করতেন। [10]
· দোয়া করার সময় কোনো ইতস্তত না করা। এরূপ না বলা যে হে আল্লাহ তুমার যদি ইচ্ছা হয় তাহলে দোয়া কবুল করো। যদি ইচ্ছা হয় তবে রহম করো। যদি ইচ্ছা হয় আমাকে রিজিক দাও। বরং দৃঢ়-প্রত্যয়ী হয়ে দোয়া করা। [11]
· মন-মস্তিষ্ক জমিয়ে হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে দোয়া করা। কেবল মুখে মুখে শব্দ উচ্চারণ করে না যাওয়া। হাদিসে এসেছে, ‘দোয়া কবুল হবে এই একীন নিয়ে আল্লাহর কাছে চাও। জেনে রাখো, আল্লাহ নিশ্চয়ই এমন দোয়া কবুল করেন না যা গাফেল ও উদাসীন হৃদয় থেকে বের হয়।[12]
একীনের সাথে দোয়া করা। কেননা আল্লাহ পাক দোয়া কবুল করার ওয়াদা করেছেন, এরশাদ হয়েছে,
(হে নবী!) আমার বান্দাগণ যখন আপনার কাছে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে, তখন (আপনি তাদেরকে বলুন যে,) আমি এত নিকটবর্তী যে, কেউ যখন আমাকে ডাকে আমি তার ডাক শুনি।[1
ওপরে বর্ণিত হাদিসেও উল্লেখ হয়েছে যে, ‘তোমরা কবুল হওয়ার একীন নিয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করো।’ [14]
· দোয়ার সময় সীমা লঙ্ঘন না করা। অর্থাৎ অতিরঞ্জিত আকারে দোয়া না করা। সা’দ (র) তাঁর এক ছেলেকে এই বলে দোয়া করতে শুনলেন যে, হে আল্লাহ আমি তোমার কাছে জান্নাত চাচ্ছি। জান্নাতের সকল নেয়ামত চাচ্ছি। ও.. ও..। আমি তোমার কাছে জাহান্নাম থেকে পানাহ চাচ্ছি। জাহান্নামের শেকল ও বেড়ি সমূহ থেকে পানাহ চাচ্ছি। ও.. ও। সা’দ বলেন, হে বৎস! আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)কে বলতে শুনেছি: এমন সম্প্রদায় আসবে যারা তাদের দোয়ায় সীমা-লঙ্ঘন করবে।[15] সাবধান তুমি তাদের দলভুক্ত হবে না। তোমাকে যদি জান্নাত দেয়া হয় তাহলে এর মধ্যে যা কিছু আছে সবকিছু সমেত দেয়া হবে। আর যদি জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেয়া হয় তাহলে জাহান্নাম ও তার মধ্যে যতো খারাপি আছে তার থেকে মুক্তি দেয়া হবে।[16]
· আল্লাহর দরবারে হীনতা-দ্বীনতা ও অপারগতা প্রকাশ করা। সকল ক্ষমতা আল্লাহর হাতে। উপকার ও অনুপোকারের ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর। আল্লাহ যদি কারও কল্যাণ করতে না চান তাহলে সমগ্র পৃথিবীর সকল মানুষ মিলেও তার কোনো উপকার সাধন করতে পারবে না। আর যদি তিনি কারো উপকার করতে চান তাহলে সমগ্র পৃথিবীর মানুষ মিলেও তা ঠেকাতে পারবে না। এ ধরনের বিশ্বাস নিয়ে নিজেকে একেবারে হীন ও দুর্বল ভেবে আল্লাহর কাছে সওয়াল করতে হবে। আল্লাহ হলেন সৃষ্টিকর্তা আর আমি অতি নগণ্য, অনুল্লেখযোগ্য একজন দাস, বান্দা। আল্লাহ হলেন ধনী আমি গরিব, অক্ষম। তিনি পবিত্র ও সকল অসম্পূর্ণতা থেকে মুক্ত। আর আমি আদ্যোপান্ত অসম্পূর্ণ। একমাত্র তিনিই বিধান দাতা আমি বিধান গ্রহীতা। এ ধরনের মন-মানসিকতা নিয়ে দোয়া করতে হবে।
· পরিব্যাপ্ত ও নবী (স) থেকে বর্ণিত শব্দ ও বাক্য ব্যবহার করা। কেননা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যে শব্দ ও বাক্য ব্যবহার করেছেন তা পূর্ণাঙ্গ ও পরিব্যাপ্ত, ‘জামে’। এক বর্ণনায় এসেছে, ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)পরিব্যাপ্ত দোয়া পছন্দ করতেন, ও অন্যগুলো ছেড়ে দিতেন। [17]
· পরিত্রাণ পাওয়ার দোয়া অধিক পরিমাণে করা। কেননা দুনিয়া ও আখেরাতে যে ব্যক্তি পরিত্রাণ পেয়ে গেল তার চেয়ে সৌভাগ্যবান আর কেউ হতে পারে না। হাদিসে এসেছে, ‘পরিত্রাণের দোয়া বেশি,বেশি করো’। [18]
· দোয়া কবুলের জন্য মাধ্যম হিসেবে কিছু পেশ করা। যেমন আল্লাহর নাম ও সিফাত-গুনাবলীর উসিলায় দোয়া তলব করা। এরশাদ হয়েছে,
আল্লাহর আছে সুন্দর নাম-সমগ্র, সেগুলো দিয়ে তাঁকে ডাকো।[19]
কোনো ব্যক্তিকে উসিলা বানিয়ে দোয়া করা কখনো উচিৎ নয়। দোয়া করার সময় বেশি বেশি ‘ইয়া যাল্জালালি ওয়াল ইকরাম’ বলা। হাদিসে এসেছে,‘(তোমাদের দোয়ায়) বেশি বেশি ইয়া যালজালালি ওয়াল ইকরাম বলো।[22]
· ইসমে আজম দিয়ে দোয়া করা। এক বর্ণনায় এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)এক ব্যক্তিকে এই বলে দোয়া করতে শুনলেন যে, হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে সওয়াল করছি (এই একীন নিয়ে) যে আপনি আল্লাহ, অদ্বিতীয় ও অমুখাপেক্ষী। কাউকে জন্ম দেননি, কারও থেকে জন্ম গ্রহণও করেননি। আর তাঁর কোনো সমকক্ষ নেই। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)বললেন, লোকটি আল্লাহর ইসমে আজম দিয়ে সওয়াল করেছে। যার দ্বারা সওয়াল করলে আল্লাহ দান করেন, দোয়া করলে কবুল করেন।[23]
· বেশি বেশি চাওয়া এবং অতিমাত্রায় অনুনয়-বিনয় করা। হাদিসে এসেছে, ‘তোমাদের কেউ যখন সওয়াল করবে সে যেন বেশি মাত্রায় করে। কেননা সে আল্লাহর কাছে সওয়াল করছে।’
· কেবলামুখী হয়ে দোয়া করা। কেননা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)কেবলামুখী হয়ে দোয়া করতেন।[26]
· দোয়া শেষ হলে ‘আমীন’ বলা।
0 Comments