সম্মানিত মাস মহররমের ইবাদতঃ আশুরার গুরুত্ব, ফজিলত ও করণীয়


আশুরার অর্থ কি

আশুরা শব্দটি আশারাহ শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ আরবীতে দশ। হিজরি বছরের প্রথম মাস মহরমের মাসের দশম দিবসকে আশুরা বলা হয়।

মহরম -আল্লাহর পবিত্র মাস যাতে 'আশুরা'র আগমন ঘটেঃ

মহান রব্বুল আলামিন যে চারটি মাসকে আশহুরে হুরুম তথা অতি সম্মানিত বলে ঘোষণা করেছেন, তার অন্যতম মহররম, যা হিজরি বর্ষের প্রথম মাস। আর এ মাসের ১০ তারিখের দিনটিকে আশুরা দিবস বলা হয়।

পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেনঃ



অর্থাৎ সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে আল্লাহতায়ালা ১২টি মাস নির্ধারণ করে দেন। তন্মধ্যে চারটি মাস বিশেষ গুরুত্ব ও তাৎপর্য বহন করে।

ওই চারটি মাস কী কী?

এর বিস্তারিত বর্ণনা হজরত আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, হাদিসে উল্লিখিত হয়েছে, নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন, এক বছরে ১২ মাস। এর মধ্যে চার মাস বিশেষ তাৎপর্যের অধিকারী। এর মধ্যে তিন মাস ধারাবাহিকভাবে আসে অর্থাৎ জিলকদ, জিলহজ ও মহররম) এবং চতুর্থ মাস মুজর গোত্রের রজব মাস। (সহিহ বোখারি: ৪৬৬২ ও মুসলিম: ১৬৭৯)

আশুরা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন কেন?

পৃথিবীর সৃষ্টিলগ্ন থেকে অসংখ্য ঐতিহাসিক, অলৌকিক ও চাঞ্চল্যকর ঘটনার সাথে সম্পর্কিত এ আশুরা। আশুরার দিনে সংঘটিত হয়েছে অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা ও হৃদয়বিদারক কাহিনী।

আশুরার ঐতিহাসিক ও অলৌকিক ঘটনা

·     এ দিনে আল্লাহতায়ালা তার নবী মুসা আলাইহিস সালাম ও তার অনুসারী ইমানদারদের ফেরাউনের জুলুম থেকে নাজাত দিয়েছিলেন এবং ফেরাউনকে তার বাহিনীসহ সমুদ্রে ডুবিয়ে মেরেছেন। এ কারণে আল্লাহর শোকারিয়া আদায় স্বরূপ হযরত মূসা (আ:) এই দিনে রোজা পালন করেছিলেন এবং একই কারণে ইহুদিরাও আশুরার দিন রোজা রাখে।

·       এ ছাড়া ইসলাম ধর্মমতে, আশুরার দিনে আসমান ও জমিন সৃষ্টি করা হয়েছিল। আশুরার দিন আল্লাহ পৃথিবীর প্রথম মানব হযরত আদম (আ.) কে সৃষ্টি করেছেন।

·      এই দিনে আল্লাহ নবীদেরকে স্ব স্ব শত্রুর হাত থেকে আশ্রয় প্রদান করেছেন। এই দিন হযরত নুহ (আ.) এর প্লাবন শেষ হয় এবং নুহ (আ.) এর জাহাজ তুরস্কের জুদিনামক পর্বতে গিয়ে থামে। আশুরার দিন হযরত ইব্রাহিম (আ.) জালিম বাদশাহ নমরুদের অগ্নিকুণ্ড থেকে নিরাপদে মুক্তি পেয়েছিলেন। এই দিন হযরত ইউনুস (আ.) মাছের পেট থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। আশুরার দিনে হযরত আইয়ুব (আ.) দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। আশুরার দিন হযরত সুলাইমান (আ.) তার হারানো রাজত্ব ফিরে পান। এইদিনে হযরত ইয়াকুব (আ.) হারানো ছেলে হযরত ইউসুফ (আ.) কে ৪০ বছর পর ফিরে পেয়েছিলেন।

·       এইদিনে হযরত ঈসা (আ.) জন্মগ্রহণ করেন এবং এইদিনেই তাকে দুনিয়া থেকে আকাশে উঠিয়ে নেয়া হয়।

·       রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আশুরা পালন ছিল মহরমের মাসের ১০ তারিখ রোজা পালন এবং সাহাবিদের রোজা পালনের নির্দেশ।

আশুরার হৃদয়বিদারক ঘটনা

·       হযরত মুহাম্মদ সা.-এর ওফাতের মাত্র পঞ্চাশ বছর পর হিজরি ৬১ সনের ১০ মহররম রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দৌহিত্র হজরত হোসাইন রাদিআল্লাহু আনহু কারবালার প্রান্তরে নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। যা ইতিহাসে মুসলিম উম্মাহর জন্য হৃদয়বিদারক ঘটনা।

আশুরার রোজাঃ

আশুরার দিন তথা মুহাররাম মাসের ১০ তারিখ রোজা অত্যন্ত ফজিলতের কাজ।

ইবন আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) মদিনায় এসে দেখলেন, ইহুদিরা আশুরার দিনে রোজা রাখছে। তিনি (স.) তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন এটা কোন দিবস যে তোমরা রোজা রাখছ? তারা বলল-এটা এমন এক মহান দিবস যেদিন আল্লাহ তায়ালা মুসা (আ.) ও তাঁর সম্প্রদায়কে নাজাত দিয়েছিলেন এবং ফেরাউনকে তাঁর দলবলসহ ডুবিয়ে মেরেছিলেন। মুসা (আ.) কৃতজ্ঞতা স্বরূপ এ দিনে রোজা পালন করেন। এ কারণে আমরাও রোজা পালন করে থাকি। এ কথা শুনে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,

তোমাদের চেয়ে আমরা মুসা আলাইহিস সালামের অধিকতর ঘনিষ্ঠ ও নিকটবর্তীঅতঃপর রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোজা পালন করলেন এবং সাহাবিদের রোজা পালনের নির্দেশ দিলেন। (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ২৭১৪)। 

 

আশুরার রোজা গুরুত্বঃ নফল হলেও এর গুরুত্ব অধিক

মহররম মাসে রোজা রাখা সম্পর্কে অনেক বিশুদ্ধ হাদিস বর্ণিত হয়েছে। বিশেষভাবে আশুরা, অর্থাৎ মহররমের ১০ তারিখে রোজা রাখার ফজিলত সম্পর্কে অনেক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। একটি হাদিস থেকে প্রতীয়মান হয়, রমজান মাসের রোজা ফরজ হওয়ার আগে আশুরার রোজা উম্মতে মুহাম্মদীর ওপর ফরজ ছিল। পরবর্তী সময়ে রমজান মাসের রোজা ফরজ হওয়ায় অবশ্যই ওই বিধান রহিত হয়ে যায় এবং তা নফলে পরিণত হয়।মহররম কেবল পবিত্রই নয়, নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেমন উল্লেখ করেছেন, তেমনি আল্লাহর মাস হিসাবেও উল্লেখ করা হয়েছে, যখন তিনি বলেছিলেন,

রমজানের পর সবচেয়ে ভাল রোজা আল্লাহর মহররম মাসের রোজা ।” (মুসলিম)

ওই হাদিসের আলোকে আশুরার রোজার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতীয়মান হয়। এমনকি ওই সময়ে তা ফরজ ছিল। বর্তমানে এই রোজা যদিও নফল, কিন্তু অন্যান্য নফল রোজার তুলনায় অধিক গুরুত্বপূর্ণ।

আশুরার রোজার ফজিলতঃ বিগত এক বছরের গুনাহ মাফ

আশুরার রোজা পালনের ফজিলত সম্পর্কে হজরত আবু কাতাদাহ রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদিস রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

আশুরার দিনে রোজা রাখার উছিলায় আল্লাহতায়ালা আগের এক বছরের (সগিরা) গুনাহ মাফ করে দেবেন। (সহিহ মুসলিম)

আশুরার রোজার পদ্ধতিঃ কোন তারিখে রোজা রাখতে হবে ?

মুসলিম শরিফে হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘মহানবী (সা.) যখন আশুরার দিনে রোজা রাখেন এবং অন্যদেরও রোজা রাখার নির্দেশ প্রদান করেন, তখন সাহাবিরা অবাক হয়ে বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! ইহুদি-নাসারারা তো এই দিনটিকে বড়দিন মনে করে সম্মান প্রদর্শন করে থাকে। (আমরা যদি এই দিনে রোজা রাখি, তাহলে তো তাদের সঙ্গে সামঞ্জস্য হবে। তাদের প্রশ্নের উত্তরে রাসূল (সা.) বললেন, 'তারা যেহেতু এদিন একটি রোজা পালন করে) আগামী বছর ইনশাআল্লাহ আমরা এই ১০ তারিখের সঙ্গে ৯ তারিখ মিলিয়ে দুই দিন রোজা পালন করব। -সহিহ মুসলিম: ১১৩৪

এ হাদিসের আলোকে অনেকে বলেন কেউ ইচ্ছা করলে মুহাররমের ৯ ও ১০ তারিখ রোজা রাখবে। এতে ইহুদিদের সাদৃশ্য পরিত্যাগ করাসহ আমাদের প্রিয় নবীর ইচ্ছার ও প্রতিফলন ঘটবে।

ভ্রান্ত ধারণার আবসানঃ আশুরা  মানে কি শুধুই কারবালার ঘটনা ?

আশুরার কথা মনে হলেই কারবালার কথাই প্রথমে মনে পড়ে । কারবালার ইতিহাসকে ঘিরেই আশুরার সব ঐতিহ্য, এতেই রয়েছে আশুরার সব রহস্য। আসলে বাস্তবতা কিন্তু এর সম্পূর্ণ বিপরীত।

অনেকেই না বুঝে অথবা পুরোপুরি না জেনে আশুরার ঐতিহ্য বলতে শুধুমাত্র রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রিয়তম দৌহিত্র, জান্নাতের যুবকদের সরদার হজরত হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাত ও নবী পরিবারের কয়েকজন সম্মানিত সদস্যের রক্তে রঞ্জিত কারবালার ইতিহাসকেই বুঝে থাকে। বরং আশুরার ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে প্রাচীনকাল থেকেই। হজরত হুসাইন (রা.)-এর মর্মান্তিক শাহাদাতের ঘটনার অনেক আগ থেকেই আশুরা অনেক তাৎপর্যপূর্ণ ও রহস্যঘেরা দিন। কারণ কারবালার যুদ্ধ সংঘটিত হয় ৬১ হিজরির ১০ মহররম। হযরত মুহাম্মদ সা.-এর ওফাতের মাত্র পঞ্চাশ বছর পর ফোরাতের তীরে কারবালা কঙ্করময় প্রান্তরে মুহাম্মদ সা.-এর অন্যতম প্রিয় দৌহিত্র হযরত হোসাইন রা. সপরিবারে তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে মুআবিয়া পুত্র ইয়াজিদের হাতে শাহাদাৎ বরণ করেন। এ অধ্যায়কে ইসলামের ইতিহাস আজও বেদনার রক্ত দিয়ে লেখা রয়েছে। মুসলামানদের কাছে আশুরার ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও তাৎপর্য ব্যাপক গভীর। আর আশুরার রোজার প্রচলন চলে আসছে ইসলাম আবির্ভাবেরও বহুকাল আগ থেকে। আবহমানকাল থেকে আশুরার দিনে সংঘটিত বিভিন্ন ঐতিহাসিক, অলৌকিক ঘটনা যেমন অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি হিজরি ৬১ সনে আশুরার দিন কারবালার ময়দানের হজরত হুসাইন (রা.)-এর মর্মান্তিক শাহাদাতের দুঃখজনক ঘটনাও মুসলিম জাতির জন্য অতিশয় হৃদয়বিদারক ও বেদনাদায়ক। কারবালাই মুসলমানদের শিক্ষা দিয়ে গেছেইসলামের জন্য চাই ত্যাগ ।।

Post a Comment

1 Comments

CPH IT Solution said…
What a great article. Learned so many new amals.